পাঁচিলের ওপারে একটা বিস্তৃত মাঠ। বেশ কিছু নারিকেল আর সুপারী গাছ, আর অনেক ঝোপঝাড়। খুব একটা পরিচর্যা করা হয় না বোঝাই যাচ্ছে, অযতনে বেড়ে উঠেছে ঝোপঝাড়গুলো। তাতে অবশ্য আমার সুবিধাই হলো। ঝোপড়া আর গাছগাছালীর আড়ালে লুকিয়ে এগুতে লাগলাম।
মন্দির ভবনের পেছন দিকে আমার আম্মিজান ফওজিয়া জেলালকের হাতে হাত ধরে নিয়ে গেছে, আমি সেদিকেই এগিয়ে গেলাম।
খানিকটা আগাতেই দেখি জঙ্গলা এলাকা শেষ। সামনে ছোট্ট ফাঁকা এলাকা জুড়ে একটা উঠান, আর তার ওপাশে দোচালা একটা বাড়ী, তাতে সারি বেঁধে বেশ কয়েক খানা ঘর। প্রতি কামরার সামনে বারান্দা, আর ঘরগুলো সব একই নকশার। বুঝলাম এগুলো মন্দিরের সেবায়েত পুরোহিতদের বাসস্থান। তবে তাদের মধ্যে একটা ঘর বেশ বড়ো, সামনের বারান্দাটাও প্রশস্ত। ধরে নিলাম বড় ঘরটা হলো মন্দিরের পুরোহিত পণ্ডিত হরি মহারাজের বাসস্থান।
আমি চুপিসাড়ে সে ঘরটার কাছাকাছি এসে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে বসে পড়লাম।
আম্মিজান বা পণ্ডিতজীকে কোথাও দেখলাম না। তবে কি হিন্দু পণ্ডিত আমার মুসলিমা আম্মিকে তার ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে নিয়েছে? নাহ, পণ্ডিতের কামরার দরজাটা খোলাই ছিলো। আমি উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে নিলাম, নাহ ভেতরে কেউ নেই।
বসে বসে ভাবছিলাম পণ্ডিতজী তার অতিথি ফওজিয়াকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে। খানিক পরেই আওয়াজ পেলাম পদশব্দ ও নারী ও পুরুষ কণ্ঠের।
আমি সটান ঝোপটার আড়ালে শুয়ে পড়লাম, মাটির কাছে আগাছার গোছাটা একটু ফাঁক করে সামনে তাকালাম।
দেখি পণ্ডিত হরি মহারাজ আসছে, আর তার পেছন পেছন আমার আম্মিজান। বগলকাটা কামিয পরিহিতা ফওজিয়ার নাঙ্গী বাহু ধরে পণ্ডিতজী ওকে টেনে আনছে।
কিন্তু এতোক্ষণ ওরা কোথায় ছিলো? চোখের সামনে এক গোছা ঘাসের শীষ আমার দৃষ্টি ব্যাহত করছিলো, ঘাসের গোছাটা সরাতে আম্মির চেহারা নজরে আসতেই উত্তর মিললো।
আম্মির ফরসা কপালের ঠিক মধ্যিখানে কড়া লাল রঙয়ের বড়ো একটা তীলক আঁকা। আর ওর মাথার চুল খোঁপা করে বাঁধা, আর তাতে সাদা সাদা ফুলের একটা মালা বাঁধা। জুঁই বা বেলী ফুলের মালা হবে, আম্মির চুলে বাঁধা ফুলের সুঘ্রাণ আমার নাকে হানা দিলো। আম্মর কপালে লাল তিলক, আর চুলে ফুলের মালা দেখে আমি বুঝতে পারলাম, পণ্ডিত হরি মহারাজ আমার আম্মিকে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে পূজোয় শামিল করিয়েছিলো, আর পূজো শেষে মুসলমান রমণীর কপালে তিলক লাগিয়েছে, আর চুলে হিন্দুয়ানী সাজের ফুলমালা পরিয়েছে।
আমি জানি, হিন্দু মহিলারা চুলে সাদা জুঁই বা বেলী ফুলের মালা পরে। খোঁপায় পরা ফুলের মালাকে হিন্দুরা গাজরা বলে। ঠিক এমনই একটা হিন্দুয়ানী গাজরা আমার মুসলিমা আম্মির মাথায় এখন শোভা পাচ্ছে। নিশ্চয়ই পণ্ডিতজী নিজ হাতে ফওজিয়াকে তিলক লাগিয়ে গাজরা পরিয়েছে।
তবে যেটা আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট করলো, তা হলো গাজরা মালাটির অবস্থান। আমাদের বিন্দাসপূরী হিন্দু নারীরা বিশেষ রেওয়াজে গাজরা পরিধান করে থাকে। কুনওয়ারী, অবিবাহিতা হিন্দু মেয়েরা বামকানের পেছনে ফুলের মালা পরে, আর বিবাহিতা বা বাগদত্তা নারীরা পরে মাথার ডান পাশে। অনেক সময় ঘোমটার আড়ালে সিঁদুর ঢেকে যেতে পারে, তখন গাজরার অবস্থান দেখে অপরিচিত পুরুষরা বুঝে নেয় নারী ইতিমধ্যেই বিবাহিতা নাকি প্রস্তাব দেবার যোগ্য।
আমার আম্মির মাথায় যে গাজরা আছে... না, ভুল হলো... বলা উচিৎ পণ্ডিতজী আমার আম্মিকে যে গাজরাখানা পরিয়েছে, সে জুঁইয়ের মালাটির একটা প্রান্ত ওর ডান কানের পেছনে ঝুলছে। অর্থাৎ, অপরিচিত যে কেউ আমার আম্মির কপালে তীলক আর ডানকানের পেছনে গাজরা দেখে ধরে নেবে এই সুন্দরী নারী হয় কোনও ভাগ্যবান হিন্দু মরদের বিবাহিতা পত্নী, আর নয়তো কোনও হিন্দু ওকে বাগদত্তা করেছে।
আমার আম্মিজান ফওজিয়া জেলাল এখন ত্বালাকী আওরত, ওর কোনও স্বামী শোওহর নেই। তারপরও মুসলমান নারীকে ওই বিশেষ সাজে বিবাহিতার গাজরা কেন পরিয়েছে পণ্ডিত তা আমার বোধগম্য হলো না।
যাকগে, যেটা ভেবেছিলাম সেটাই ঠিক, সবচেয়ে বড়ো ঘরখানাই পুরোহিতের। পণ্ডিত হরি মহারাজ তার ঘরের বারান্দায় উঠলো। বারান্দায় একখানা বেত দিয়ে বোনা কুরসী রাখা ছিলো। পণ্ডিতজী সেটায় বসে পড়ে পিঠ হেলিয়ে দিলো।
বারান্দায় একটা মাত্র কুরসী ছিলো, তাই আম্মি বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো। তবে পণ্ডিতের মধ্যে আম্মিকে বসতে দেবার ব্যবস্থা করবার কোনও তাগিদ দেখলাম না।
আর তখন সেবায়েতটা হাতে বুরকা নিয়ে হাজির হলো। ফটকে প্রবেশের সময় এই লোকটাই আম্মিজানের বুরকাটা হরণ করে ওকে উন্মোচিত করেছিলো।
আম্মি দাঁড়িয়ে আছে দেখে সেবায়েতটা ওকে বসতে বললো।
সেবায়েতঃ সে কী?! দাঁড়িয়ে আছো কেন? পণ্ডিতজীর পদচরণে বসে পড়ো।